গুডরিডসে ঘাটতে ঘাটতে বইটি আমার নজরে আসে। বই এর টপিক এবং রেটিং দুটোই আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়। বিষাক্ত প্রাণীদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট নিয়ে লেখা বই আমার কখনো পড়া হয় নি। এটাই প্রথম।
এই বই এর লেখিকা ক্রিস্টি উইলকক্স একজন উদীয়মান গবেষক এবং বিজ্ঞানলেখক হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কার জিতেছেন। এই বইটি লেখার সময় তিনি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ল্যাব পরিদর্শন এবং বিষাক্ত প্রাণী নিয়ে নিজের কাজ করার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছেন। সাথে দিয়েছেন প্রচুর বাস্তব ঘটনার রেফারেন্স। পুরো বইটি অত্যন্ত উপভোগ্য এবং সুপাঠ্য এমনকি দুর্বল ইংরেজী পাঠকদের জন্যেও। তবে কিছু বায়োলজি এবং ভেনম সংক্রান্ত শব্দ বোঝার জন্য সার্চ ইন্জিনের সাহায্য নিতে হতে পারে।
নিচে আমি বইটিতে পড়া কিছু উল্লেখযোগ্য অংশের সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ দিয়ে দিচ্ছি যাতে করে আপনারা বইটি সম্পর্কে কিছু ধারণা পেতে পারেন।
ভাবানুবাদাংশ ১ঃ
কোন
বিষের বিষাক্ততা পরিমাপের একটি মাপকাঠি হলো Lethal Dose বা LD । LD50 বলতে
বোঝায় একটা রেন্ডম স্যাম্পল টেস্ট কেসের অর্ধেককে মেরে ফেলতে কিরকম ডোজ
দেয়া লাগতে পারে, LD100 দিয়ে বোঝায় রেন্ডম স্যাম্পল টেস্টকেসের সবাইকে মেরে
ফেলতে ন্যুনতম কি পরিমাণ ডোজ প্রয়োজন।
পানির LD50 মান হলো ৯০,০০০
মিলিগ্রাম/কিলোগ্রাম। অর্থাৎ মানুষের (কিংবা পরীক্ষাকৃত জীবের) শরীরের
প্রতিকেজি ওজনের বিপরীতে তাকে ৯০ গ্রাম পানি দিতে হবে। ৭০ কেজি ওজনের একজন
মানুষকে পানি খাইয়ে মেরে ফেলতে হলে তাকে ৬.৩ কেজি পানি খাওয়াতে হবে। এটাকে
অবিষ দ্রব্যই বলা চলে। আবার বটুলিনাম (বিশেষ জাতের মাশরুম হতে প্রাপ্ত একটি
বিষ) এর LD50 পরিমাণ হলো ১ ন্যানোগ্রাম/কিলোগ্রাম। সবার জ্ঞাতার্থে বলছি ১
ন্যানোগ্রাম হলো ১ গ্রামের ১০০ কোটি ভাগের একভাগ। অর্থাৎ মাত্র ৭০
ন্যানোগ্রাম বটুলিনাম দিয়ে একজন স্বাভাবিক মানুষকে মেরে ফেলা সম্ভব।
আবার
চামড়া বেচে খাওয়া সেলেব্রিটিদের নিকট বটুলিনাম খুব প্রিয় একটি ব্যাপার।
০.১ ন্যানোগ্রাম বটুলিনাম যদি ইন্জেকশনের মাধ্যমে মানুষের কপালে প্রবেশ
করানো যায় তবে তার কপালের ভাজ সোজা হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটি সাধারণভাবে
বটক্স (Botox) নামে পরিচিত সবার কাছে।
ভাবানুবাদাংশ ২ঃ
সকল ভেনমই প্রোটিন। তবে অন্যান্য প্রোটিন থেকে তাদের কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। ভেনম বিশেষ সময়ে নিঃসৃত হয়, সর্বদা হয় না। ভেনম প্রস্তুত করতে শরীরে প্রচুর শক্তি খরচ হয়, সর্বদা নিঃসৃত হয়ে এর অপচয় করা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
এই প্রোটিনগুলো বিশেষ ক্ষমতা থাকে। যেমন কিছু ভেনম কোষের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানকে ভেঙে দিতে পারে (একারণে বিশেষ জাতের সাপ এবং মাকড়সার কামড়ে শরীরে ক্ষতস্থান সৃষ্টি হয় এবং পচনও ধরতে পারে)। কিছু ভেনম প্রোটিন শরীরকে ভুল সিগনাল দিতে পারে (এজাতের ভেনম প্লাটিলেটকে ভুল সংকেত
দিয়ে জমিয়ে ফেলে, ফলে ধমনী-শিরায় ব্লকের সৃষ্টি হয় এবং শরীরের অন্যান্য জায়গায় প্লাটিলেটের অভাবে ইন্টারনাল ব্লিডিং ঘটে)। কিছু ভেনম শরীরের রিসেপ্টর কোষ যেমন হিমোগ্লোবিনকে ব্যস্ত করে ফেলে, যাতে করে শরীরের ভিতরের কাজগুলো বিঘ্নিত হয়।
এই প্রোটিনগুলো খুব দ্রুত কাজ করে। যদি ভেনম ধীর হতো তবে এটার উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতো। শিকারের উদ্দেশ্যে যদি সাপ ছোবল দেয় এবং বিষ ধীরে কাজ করে তাহলে শিকার পালিয়ে যাবে। আবার আত্মরক্ষার্থে যদি ছোবল দেয় কিন্তু বিষ কাজ করতে সময় লাগে তাহলে সাপ আক্রমণকারীর হাতে মারা পড়বে।
এসব প্রোটিনের স্ট্যাবিলিটিও অনেক বেশি। এরা বিভিন্নভাবে ভাঁজ হয়ে থাকে স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য, সাথে প্রোটিন অণুগুলো নিজেদের মাঝে ডাইসালফাইড ক্রসলিংকিং এর মাধ্যমে যুক্ত থাকে।
ভেনমগুলোর মাঝে এসব সাদৃশ্য সকল ভেনমের জন্য প্রতিষেধক এন্টি-ভেনম তৈরিতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে। কেননা রোগীরা অনেক সময়েই ঠিক মতো বলতে পারে না যে, সে কার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। আবার আক্রান্ত হবার পর বিপদের পরিমাণটাও ঠিকভাবে ধরতে পারে না। যেসব সাপ কামড় দেয়ার আগে ঠিকমতো সংকেত দেয় না (গোখরো ফণা তোলে, রেটল স্নেক ঝুনঝুনি বাজায়; কিন্তু বোরা বা মাম্বা সাপ কোন সতর্কতা না দেখিয়েই কামড় দেয়) তাদের কামড়ের পর বীভৎস ক্ষত, যন্ত্রণা বা এধরণের লক্ষণ কম দেখা যায়। ফলে রোগীরা অবহেলা করে। একারণেই হেমোটক্সিনের ফলাফল অনেক বীভৎস, কিন্তু নিউরোটক্সিনের কার্যক্রম নীরব এবং ভয়াবহ।
ভাবানুবাদাংশ ৩ঃ
কুকুর বিছে দেখলে সচকিত হয়ে ওঠে, বানর সাপের চিহ্ন দেখলে পালিয়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক, কোন প্রাণীই অন্য বিষাক্ত প্রাণীর কামড় খেতে চায় না। তবে এই প্রাণী জগতে একটা কিম্ভুত কিমাকার স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে, যাদের কাউকে কাউকে সেধে বিষাক্ত প্রাণীর কামড় খেতে দেখা যায়, এমনকি এর জন্য তারা টাকাও খরচ করতে রাজী থাকে। বুঝতেই পারছেন প্রাণীটা হলো হোমো স্যাপিয়েন্স।
একদল মানুষ আছে, যারা বিশ্বাস করে অল্প ডোজে সাপের বা যেকোন বিষাক্ত প্রাণীর বিষ রক্তে গ্রহণ করলে তারা ধীরে ধীরে ওই বিষের বিরুদ্ধে শরীরে
কেমিক্যাল অর্জন করতে পারে। কথাটা খুব ভুলও না। টিম ফ্রেইড নামে এরকমই এক ব্যক্তি পৃথিবীর সবচাইতে বিষাক্ত সাপ মাম্বার কামড় খেয়ে বহাল তবিয়তে থেকে ব্যাপারটার যৌক্তিকতা কিছুটা হলেও প্রমাণ করেছেন।
আমেরিকার উচ্চমার্গীয় পার্টিতে আপনি কোকেন পাবেন। কিন্তু একই ধরণের বিলাসবহুল পার্টি যদি ভারতে হয়, সেটা আপনাকে সাপের বিষ পাইয়ে দিতে পারে। এক চিমটি শুকনো সাপের বিষের পাউডার এর দাম এখানে প্রচলিত অন্যান্য মাদকের পাঁচ থেকে দশগুণ। স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের(!) মতে এটা আপনাকে এতটাই উচ্চমার্গে তুলতে সক্ষম যে, মাদকগ্রহণকারীরা কোথায় আছে, কি করছে সব হুশ হারিয়ে ফেলে।
সমস্যা হলো এর অনেক দাম, বড়লোকের নষ্ট ছেলেরা ছাড়া সবাই এটার নাগাল পায় না। এখানেই খেলে ছিচকে বিক্রেতারা যারা তরল বিষের জোগান দিতে পারে, এক লিটারের দাম তিন লাখ আমেরিকান ডলার এবং এ পরিমাণ বিষ জোগান দিতে দুইশ সাপের সারাজীবন লাগে। এই তরল বিষ যোগানদাতারা মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের বিভিন্ন অভিযানের লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকে। প্রায়ই কাচের জারভর্তি এবং কন্ডমভর্তি বিষসহ মাদক বিক্রেতা ধরার ঘটনা ভারতের খবর চ্যানেলগুলোতে প্রচার হয়ে থাকে।
পাউডার বিষ কিংবা তরল বিষ এই দুটোও সবসময় এই মহামূল্যবান নেশাপ্রিয়দের আওতায় থাকে না। তাই তারা এই নেশা করার জন্য ডিরেক্ট চ্যানেল ধরে। ভারতের কিছু শহরে ডিলার থাকে যারা বিনোদনমূলক সাপের কামড় সরবরাহ করে থাকে। আপনি তাদের সাপঘরে যাবেন, টাকা দেবেন তারপর সাপের কামড় খেয়ে নেশা করবেন; একদম সিম্পল! সেখানে ছোট ছোট খুপড়িও থাকে যাতে করে আপনি সাপের কামড় খাবার পর ওখানে বসেই পিনিক উপভোগ করতে পারেন। কিছু সাপঘরে এত রকম বৈচিত্র্যময় সাপ থাকে যে, আপনি মৃদু/মাঝারি/তীব্র কামড় বেছে নিতে পারবেন।
জনাব পিকেডি যিনি তার বায়ান্ন বছরের জীবনে বিভিন্ন রকম নেশা করার পর বৈচিত্র্যের জন্য এখন সাপের কামড় খান। বেশি দামে বিষের গুড়ো না কিনে এক বেদের কাছে গিয়ে সপ্তাহে একবার করে বাহুতে সাপের ছোবল নিয়ে আসেন। তার ভাষায় নেশা শুরু হয় ঝিমুনি ও ঝাপসা দৃষ্টি দিয়ে, তারপর আসে এক অতীব উচ্চমার্গীয় ভাসমান অনুভূতি যেটা আফিম খেয়েও তিনি পেতেন না। তামিলনাড়ুতে দুজন সফটওয়ার ইন্জনিয়ারের খোঁজ পাওয়া যায় যারা সাপের বিষের দিকে ঝোকে নার্ভাসনেস আর ইনসমনিয়া কাটানোর জন্য। তারা যেই আস্তানায় যেতো সেখানে এই সাপের কামড়ের আনন্দ নিতে গিয়ে মোট ছয়জনের মৃত্যু হয়েছিলো। এত বড়ো ঝুঁকিও তাদের এই নেশা থেকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি।
শুরুতে যাদের কথা বলা হয়েছিলো, নিজেদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে যারা সাপের বিষ ইন্জেকশনের মাধ্যমে শরীরে গ্রহণ করেন, তারাও এই উচ্চমার্গীয় অনুভূতি পাবার কথা উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে। একজন অল্পমাত্রায় বিষ নেবার পরের অনুভূতি বর্ণনা করেছিলেন, 'ভালো এবং নিরাপদ উচ্চমার্গীয় অনুভূতি' বলে।
_____
পাঠকদের বইটি পড়ার আমন্ত্রণ রইলো। খুব ভালো না লাগুক, অন্ততঃ খারাপ লাগবে না এটুকু বলতে পারি। বই এর আরো রিভিউ পড়তে গুডরিডস এ
এই লিংক থেকে পড়ে নিতে পারেন।
বইটি হয়তো ইন্টারনেটে সহজলভ্য নাও হতে পারে। যারা বইটি পড়তে আগ্রহী তারা আমাকে ইমেইল করতে পারেন, আমি ইমেইলের মাধ্যমে বই এর অনলাইন কপি আপনাদের দিয়ে দেবো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন