কিভাবে উদ্ভিদ এ পৃথিবীর ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে

রুক্ষ পাথুরে পৃথিবী এবং মানুষের বাসযোগ্য পৃথিবী। এই দুই অবস্থার মাঝখানে সেতুবন্ধন স্থাপন করেছে বাস্তুতন্ত্রের যে উপাদান, সেটা হলো উদ্ভিদ। ইংরেজীতে PLANT। পৃথিবী বিস্ময়ের আধার। সেই বিস্ময়েরই একটি হলো সেন্টিমিটার খানেক দৈর্ঘ্যের বীজ কি করে নব্বই হাজার ঘনফুটের বৃক্ষে রূপান্তরিত হতে পারে।

 

পৃথিবীতে যেখানেই প্রাণের পদচারণা হয়েছে সবখানেই শুরু হয়েছে উদ্ভিদের মাধ্যমে। হতেই হবে কারণ জীবের জীবন নামক চলমান প্রক্রিয়াটি চলমান রাখতে প্রয়োজন শক্তির। আর শুধুমাত্র উদ্ভিদই পারে পৃথিবীর শক্তির উৎস সূর্য থেকে পনের কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসা সূর্যরশ্মিকে সালোকসংশ্লেষণ নামক জটিল প্রক্রিয়া দ্বারা খাদ্যশক্তি তথা রাসায়নিক শক্তিরূপে জমা করে রাখতে। প্রাণীরা এই শক্তি উদ্ভিদ থেকে ছিনতাই করে মাত্র।

 

বহুকাল আগে, বিভিন্ন এককোষী জীবের মাঝে এক বিশেষ ধরণের ব্যাকটেরিয়ার আবির্ভাব হয়। গোলাপী ব্যাকটেরিয়া। এখনো পূর্ব আফ্রিকায় তাদের দেখা মেলে কেনিয়ার মাগাদি হ্রদের মত কিছু জায়গায়। পুরো হ্রদটাই গোলাপী। এরা বেড়ে ওঠে সূ্র্যের অতিবেগুনী রশ্মির ছাঁকনি হয়ে থাকা লবণাক্ত পানির তলে।

ছবিঃ লেক মাগাদি


পানির আরো নিচে আবির্ভাব ঘটে আরেক ধরণের ব্যাকটেরিয়ার যারা সূর্যের আলো থেকে লাল অংশ শুষে ফেলার পর বাকি অংশ শোষণ করতো। এরা সবুজ রঙের। এই ব্যাকটেরিয়ার আগমনই নতুন ইতিহাসের সূচনা করে কেননা তারাই আদি উদ্ভিদ। ধীরে ধীরে তারাই সাগরে রাজত্ব করতে শুরু করে। নতুবা হয়তো আমরা সবুজ পৃথিবীর বদলে গোলাপী পৃথিবীকে দেখতাম। সবুজ ব্যকটেরিয়া একটা বিশেষ কাজ করতো। তারা অক্সিজেন ত্যাগ করতো সূর্যের আলো থেকে শক্তি সঞ্চয় প্রক্রিয়ায়।


আজকের উদ্ভিদও একই কাজ করে। যখন সূর্যের আলো পড়ে পাতার ক‌োষে গাদাগাদি করে থাকা ক্লোরোপ্লাস্টের উপর, তখন ক্লোরোপ্লাস্টগুলোও সেই সবুজ ব্যকটেরিয়ার মত আচরণ করে। ক্লোরোপ্লাস্টের ভিতরে Light Harvesting Complex নামে বিশেষ রিং এর মাধ্যমে আলোক ফোটন শোষিত হয়। দুটি ফোটনের শক্তি ব্যবহৃত হয় পানির একটি অণুকে পরমাণুতে বিভক্ত করতে। দুটি পানির অণু থেকে একটি করে অক্সিজেন পরমাণু মুক্ত হয়ে অক্সিজেন অণু গঠন করে এবং বাতাসে মুক্ত হয়।


ছবিঃ Light Harvesting Complex


এটা চিন্তা করা খুব মজার যে, অক্সিজেন হলো সালোকসংশ্লেষণে উদ্ভিদের তৈরি বর্জ্য। অথচ এটা না হলে আমরা বাঁচতেই পারি না। আমাদের শ্বসনের বর্জ্য এবং উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের বর্জ্যের পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে এই সৃষ্টিকুলের মাঝে গ্যাসীয় আদান-প্রদানের সাম্য। একারণেই অতিমাত্রায় বন উজাড় কিংবা আমাজনে দাবানলের মত ঘটনাগুলো উদ্ভিদ-প্রাণী ভারসাম্যের জন্য হুমকি।


পৃথিবীর মাঝে অক্সিজেন বাড়ার ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। আবির্ভাব ঘটে ওজোন গ্যাসের তৈরি ওজোনমণ্ডলের যেটা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে উপরে ১৫ থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। পৃথিবীর উপর ওজোন গ্যাসের একটা রক্ষাকারী ছাদ তৈরি হয় যার ফলে পৃথিবী পৃষ্ঠে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির পতন বন্ধ হয়ে যায়। খুলে যায় নতুন প্রাণের আগমনের দুয়ার। সুযোগ হয় নতুন প্রাণের জন্য যেটা সাগরের পানির তলায় লুকিয়ে থাকবে না, ডাঙায় উঠে আসবে। ৪০ কোটি বছর আগে প্রথমবারের মত উদ্ভিদ পানি ছেড়ে ডাঙায় মানিয়ে নিতে শুরু করে। স্কটল্যান্ডে পাথরে এরকম কিছু উদ্ভিদের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। কয়েক সেন্টিমিটার লম্বা এগলোফাইটন নামের উদ্ভিদগুলো যখন সেখানে জীবিত ছিলো স্কটল্যান্ড সেসময় ছিলো দক্ষিণ গোলার্ধে। সত্যিই, বড় বিচিত্র এই সময়রেখা। এভাবেই শুরু হয় উদ্ভিদের অগ্রযাত্রা। পানি থেকে সমুদ্রতীরে, তারপর ধীরে ধীরে বিশাল মহাদেশগুলোর বক্ষকেন্দ্রে।

 

কিন্তু তখনো উদ্ভিদ বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর পরিমাণে পানির উপর নির্ভরশীল ছিলো। জলাভূমি ছাড়া তারা বাঁচতে পারতো না, তাদের অগ্রযাত্রাও চলছিলো জলাভূমি ধরেই। তাদের পানি সংগ্রহকারী সংব্যবস্থা খুব ভালো ছিলো না। কিন্তু যখনই মূল এর আবির্ভাব ঘটলো উদ্ভিদের দেহে তখনই যেনো একটা বিপ্লব সাধিত হলো। উদ্ভিদ তার অস্তিত্বের প্রয়োজনে নরম মাটি, কিংবা শক্ত পাথর সবার বুক চিড়তে শুরু করলো। তারা অতিক্রম করলো তাদের অস্তিত্বের জন্য জলাভূমির প্রয়োজন। অর্ধশুকনো স্থানেও স্থাপিত হলো উদ্ভিদের রাজত্ব। এটাই ছিলো প্রাণিহীন ডাঙায় প্রাণের স্ফুরণের সবচেয়ে বড় ধাপ। 

 

উদ্ভিদের পিছু পিছু সমুদ্র থেকে প্রাণীরাও উঠে এলো ডাঙায়। ঠিক কোন প্রাণী প্রথম এসেছিলো বিজ্ঞানিরা নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। তবে Horseshoe Crab নামে এক ধরণের কাঁকড়া পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব তীরে। এ প্রাণীটি চল্লিশ কোটি বছর আগে ডাঙায় প্রথম আসে বলে বিজ্ঞানীরা জীবাশ্ম গবেষণা করে মন্তব্য করেছেন। এর পরপরই আসে উভচর এবং কীটপতঙ্গ। 

 

মনে রাখতে হবে যে, ৪০ কোটি বছর আগেও উদ্ভিদের গঠন ছিলো সরল ধরণের। মূল এবং সবুজ কাণ্ডসদৃশ অঙ্গ। এসময় উদ্ভিদ প্রচুর বেড়ে যাওয়ায় গাদাগাদি করে থাকা উদ্ভিদগুলো সূর্যালোক এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের অভাবে ভুগছিলো। তবে তার সমাধানও হয়। কারণ তাদের দেহে নতুন ধরণের এক অঙ্গের আবির্ভাব ঘটে বিবর্তনের মাধ্যমে। পাতা। পাতা উদ্ভিদের আলো এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিশোষণ তল বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। পাতার নিচের পৃষ্ঠে আছে অসংখ্য ছিদ্র। চোখসদৃশ এসব ছিদ্রকে বলে স্টোমাটা বাংলায় পত্ররন্ধ্র। এদের মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা যায় না এবং এরা সেকেন্ডের ১৪০ ভাগের একভাগ সময়ে খোলা এবং বন্ধ হতে পারে। প্রতিটা ছোট পাতাতেও হাজারের বেশি স্টোমাটা থাকে। এই স্টোমাটার মাধ্যমে একটা ফার্ন গাছ দিনে পাঁচ লিটারের মত কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে সক্ষম। 

ছবিঃ এগালোফাইটন

উদ্ভিদের বিকাশের সাথে সাথেই বাড়তে থাকে প্রাণিবৈচিত্র্য। প্রাণীরা দুইভাবে উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। উদ্ভিদের বর্জ্য অক্সিজেনের জন্য এবং উদ্ভিদের  প্রস্তুত করা খাবারের জন্য। উদ্ভিদেরা বেশি বেশি আলো ও গ্যাস পাবার জন্য পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করে উচু হতে থাকে। এবং উচু হতে থাকে প্রাণীদের মুখ থেকে নিজেদের পাতাকে বাঁচানোর জন্য। ডাঙার সবচেয়ে উচু প্রাণী ছিলো সরোপড নামক ডাইনোসর। তারা ১২ মিটার লম্বা ছিলো, যা প্রায় একটি চারতলা দালান এর ছাদ পর্যন্ত উচু। তার নিজেদের বাঁচাতে কিছু কিছু গাছ তার চেয়ে অনেক লম্বা হয়ে ওঠে। এজন্য পৃথিবীতে শত মিটার উচু বৃক্ষেরও উপস্থিতি আছে। যারা বেশি লম্বা হয়ে উঠতে পারে নি তারা আরো নতুন নতুন অস্ত্র নিয়ে আসে প্রাণীদের ঠেকাতে। যেমনঃ কাঁটা, কষ, প্রাণীদের জন্য অস্বস্তিকর রাসায়নিক তারা তাদের পাতা ও ফলে জমা করে রেখে দেয়। যখন কোন প্রাণী দ্বারা তারা আক্রান্ত হয় তখন তারা তাদের পাতায় প্রাণীদের জন্য অস্বস্তিকর রাসায়নিকের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

 

দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডে অবস্থিত এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা কিছুদিন আগে এক অসাধারণ আবিষ্কার করেছেন। উদ্ভিদ কোন প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হলে তারা একধরণের গ্যাস নিঃসৃত করে। সেই গ্যাস অন্যগাছের কাছে গেলে তারা বুঝতে পারে যে, কোন আক্রমণকারী প্রাণী ধারে কাছে আছে। তখন তারাও অস্বস্তিকর রাসায়নিক তাদের পাতায় জমা করতে থাকে। অর্থাৎ গাছেরা নিজেদের মধ্যেও যোগাযোগ করতে সক্ষম।

 

উদ্ভিদের মধ্যে আরেকটা বিপ্লব ঘটে যখন ফুলের সূচনা হয়। ফুল উদ্ভিদের প্রজননকে সহজতর করে তোলে এবং ফল উদ্ভিদের বীজের সুরক্ষা এবং প্রানিদের জন্য বীজ দূরে ছড়িয়ে দেবার টোপ হিসেবে কাজ করে।



উদ্ভিদের মাঝে যুদ্ধও কিন্তু ঘটে। আলো এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের জন্য রেষারেষি ছেড়ে দিলেও উদ্ভিদের যুদ্ধকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় ঘাসেরা। তারা নিজেদের মাঝে জমা করে দাহ্য পদার্থ। যখন শুকনো মৌসুমে দাবানল হয়, কাছাকাছি সকল বৃক্ষ পুড়ে মরে যায়। মাটির তলায় থাকা ঘাসের কাণ্ড ঠিকই বেঁচে থাকে এবং আবার সুবিধাজনক সময়ে জেগে ওঠে। বৃক্ষের মৃত্যুর মাধ্যমে যে নতুন জায়গাটুকু বেঁচে গেলো সেটা দখল করে ঘাস। প্রতি দাবানলে তারা তাদের রাজত্ব বৃদ্ধি করে। প্রতিবারেই একটু একটু করে বনাঞ্চলকে প্রতিস্থাপিত করে তৃণভূমি।

ছবিঃ ফুলের পরাগায়ন


ঘাস মানব সভ্যতা গড়ে উঠার পিছনে কম ভূমিকা রাখে নি। বিশ্বে ৯০% মানুষের প্রধান খাদ্য উৎপাদনকারী উদ্ভিদ ধান এবং গম উভয়েই ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। ইসরায়েলি ইতিহাসবেত্তা এবং লেখক ইউভাল নোয়াহ হারারি তার ‘স্যাপিয়েন্স’ বই এ বলেছেন, “আপনি যদি ১০ হাজার বছর আগের উত্তর আমেরিকা বা কানাডার বিস্তীর্ণ ভূমিতে যান কিংবা কানসাস, আইওয়া অথবা কানাডার ম্যানিটোবাতে যান, সেখানে কোনো গমের গাছ দেখতে পাবেন না। কিন্তু আপনি যদি আজকে এই একুশ শতকের উত্তর আমেরিকা কিংবা কানাডাতে যান, আপনি কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে যেতে পারবেন যেখানে গম ছাড়া আর কোনো কিছু আপনার চোখেই পড়বে না। তারা মানুষকে গমের বীজের লোভ দেখিয়ে মানুষকে বাধ্য করেছে গমের বীজ সংরক্ষণ করতে।” মূলতঃ তিনি যা বলতে চেয়েছেন মানুষকে খাদ্যের লোভ দেখিয়ে গম গাছ মানুষকে দিয়ে তাদের চাষ করিয়েছে, দূর থেকে দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে, তুরস্কের একটি ছোট্ট খামার থেকে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বে।

 

ছবিঃ দাবানল


নিশ্চিতভাবেই আমরা মানব সভ্যতা কিংবা প্রাণিকুলের বৈচিত্রের জন্য উদ্ভিদের গুরুত্ব যতটুকু মনে করি তার চেয়ে উদ্ভিদের ভূমিকা অনেক বেশি। যতই জানা যাচ্ছে, বিজ্ঞানীরা ততই বিস্মিত হচ্ছেন উদ্ভিদের অবদান অনুধাবন করে।




তথ্যসূত্রঃ 

  1. BBC Documentary Series “How To Grow A Planet”

  2. Book ‘Sapeins’ by Yuval Noah Harari


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ফরমাল মেইল লিখার নিয়ম

বই রিভিউঃ Venomous: How the Earth's Deadliest Creatures Mastered Biochemistry

দলিলে ব্যবহৃত ১৩০ টি অতি অপ্রচলিত শব্দ